খোন্দকার কাওছার হোসেন ॥ বরিশাল সিটি নির্বাচনে ভোটের ফ্যাক্টর হবে জাতীয় ইসুু। স্থানীয় কোনো ইস্যু এখানে কার্যকর নয়। ফলাফল নির্ধারনে মানদন্ড হবে নৌকা ও ধানের শীষের মর্যাদার লড়াই। প্রার্থী কিংবা কোনো নেতার ব্যক্তিগত ইমেজ ফলাফলে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন ভোটাররা। গত কয়েক দিন ভোটের মাঠে সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। নগরীর উচু তলা থেকে নীচুতলার সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অভিজ্ঞজন, রাজনীতি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে সিটি নির্বাচন স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও এটি আর পুরানো রূপে নেই। এক সময়ের সার্বজনীন এ নির্বাচনে এখন জাতীয় নির্বাচনের আদল পেয়েছে। এ কারণে বরিশালের ভোটারদের চিন্তা চেতনায় ও এসেছে পরিবর্তন। ভোটারা এখন আর প্রার্থী দেখে ভোট দেন না, তারা ভোট দেন প্রতীক দেখে। বরিশালে আগামী ৩০ জুলাইয়ের ভোটেও প্রার্থীর যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচিতিই মুখ্য হয়ে ওঠবে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে। তারপরও কিছুটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ভোট প্রাপ্তিতে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এজন্যই বরিশাল শহর এখন বহিরাগতদের দখলে। এসব বহিরাগতরা এসে শহরে আত্বীয় স্বজনদের বাড়ি বাড়ি অবস্থান করে নিজের দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোট নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখছে।
বরিশাল নগরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ নির্বাচিত হতে দলীয় রিজার্ভ ভোটের পাশাপাশি যে ভোট ফ্যাক্টর হতে পারে তা হলো তার পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও দাদা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ব্যক্তি ইমেজ। সঙ্গে রয়েছে আত্মীয় স্বজন, সংখ্যালখুদের রিজার্ভ ভোট। পাশাপাশি প্রায় ৩১ হাজার নতুন ভোটার যাদের বেশীর ভাগ ভোট সাদেক পাবেন বলে আওয়ামী লীগের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সাদেকের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাশীন, তার ফুফু শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। পিতা মন্ত্রী, আত্মীয়দের অধিকাংশই মন্ত্রী এমপি কিংবা ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে রয়েছেন। বরিশালের উন্নয়নে তাকে বেগ পেতে হবে না। এমন বিবেচনা তার ভোট ব্যাংককে অধিকতর শক্তিশালী করবে। বস্তি, কলোনীর দরিদ্র ভোট ও বর্ধিত অনুন্নত বঞ্চিত এলাকার ভোট সাদেককে এগিয়ে রাখবে। নারী ভোটাররাও সাদেকের জন্য আর্শিবাদ হতে পারে। বিএনপির অভ্যান্তরিন কোন্দল সাদেকের জন্য সাপে বর হতে পারে। এর বাইরে সাদেকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপির ধানের শীষের ভোটে ভাগ বসানো জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলনের প্রাপ্ত ভোট সাদেকের বিজয়ে বড় নেয়ামক শক্তি হতে পারে। কেননা নগরের ভোটে ইসলামী আন্দোলনের হাত পাখা প্রতীকের একটি বড় ভোট ব্যাংক রয়েছে। যে পুঁজিকে ভর করে দলটি তাদের প্রার্থী দাড় করিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন যদি হাতপাখায় তাদের দলীয় ও হেফাজতে ইসলামীর সব ভোট বাক্সে ঢোকাতে পারে তা চুড়ান্ত ফলাফলে সাদেককে অনেকখানি এগিয়ে রাখবে। জাতীয় পার্টির বহিস্কৃত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী বশির আহমেদ ঝুনুর প্রাপ্ত ভোটও বিয়োগ হবে সরোয়ারের ধানের শীষের বাক্স থেকে এমন হিসেবই করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
সাদেকের ভোট প্রাপ্তিতে আরো একটি পালক যোগ হবে সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত শওকত হোসেন হিরনের মেয়র থাকাকালীন উন্নয়ন কর্মকান্ড। যার ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ মহানগরে বিএনপির ভোটে ভাগ বসিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও বেড়েছে হিরনের উন্ন্য়ন কর্মকান্ডের ফসল হিসেবে। তবে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের প্রার্থী ডা. মণিষা চক্রবর্তীর মই প্রতীক ও কমিউনিষ্ট পার্টির আবুল কালাম আজাদের কাস্তে প্রতীক সাদেকের ভোটে ভাগ বসাবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তা উল্লেখ করার মত নয় বলে জানিয়েছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্ময় পরিষদের সাবেক সভাপতি এডভোকেট এসএম ইকবাল। দখিনের খবরকে তিনি বলেন, নগরে এ দুটি দলের ভোট অতি নগন্য। যা নৌকার ভোটের জন্য কোন নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট তৈরি করবে না। তিনি বলেন, এবারে মানুষ ব্যক্তিকে নয় দল ও মার্কাকে ভোট দেবে। তবে ভিন্ন মত দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী। তিনি দখিনের খবরকে বলেন, যাদের হাতে দেশের ভোট ব্যবস্থার মৃত্যু হয়েছে তাদের বরিশালবাসী ভোট দেবে বলে আমার মনে হয় না। তিনি বলেন, বরিশালের মানুষের কাছে মার্কা হল আসল। ব্যক্তি এখানে গৌন হয়ে যাবে। ফলাফল নির্ধারিত হবে জাতীয় ইস্যুতে।
অন্যদিকে বিএনপি জন্য ভোটের ফ্যাক্টর জাতীয় ইস্যু হলেও আওয়ামী লীগের অপ্রকাশিত কোন্দলকে তারা বিএনপির ভোটে কাজে লাগাতে চায়। এর বাইরে দলীয় প্রার্থী সরোয়ারের নিজস্ব ক্যারিশমা, বারবার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা, দলের নেতা কর্মী, নিজস্ব ভোট ব্যাংক, জাতীয় ইস্যূ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা, খালেদা জিয়ার মুক্তি, সরকারি বাহিনীর হত্যা গুমকে পুঁজি করতে চায় বিএনপি। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোট বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর ভোট ও হেফাজতের একাংশের ভোট এবং আলেম ওলামা ও নারী ভোটকে প্রধান্য দিচ্ছে বিএনপি। এর সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে চলমান কোটা আন্দোলনকারীদের সমর্থন পাওয়ারও আসা করছে বিএনপি। যার সঙ্গে সংখ্যালঘুদের একাংশের ভোটও ধানের শীষের বাক্সে পড়বে বলে বিশ্বাস করে বিএনপি। মাঠের পরিস্থিতি যা ই হোক ভোটের নিয়ামক শক্তি হচ্ছে জাতীয় ইস্যু এটা এখন নিশ্চিত।
এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নগরের ২৬ নং ওয়ার্ডের জাগুয়া এলাকার বাসিন্দা হাসেম ঘরামী বলেন, এবারের ভোট আর গতবারের ভোট এক নয়। গতবার ভোটে দলীয় মার্কা (প্রতীক) ছিল না। এবার কেউ দলের বাইরে ভোট দেবে না। তিনি জানান, ধনী গরীব সবাই এখন রাজনীতি বোঝে, ভোটাররা কোন না কোন দলকে সমর্থন করে। যদি মানুষ কেন্দ্রে যেতে পারে তবে নিজের পছন্দের বাইরে ভোট দেবে না। আর যদি কেন্দ্রে যেতে না পারে সেটা আলাদা ব্যাপার। ২৯ নং ওয়ার্ডের বাঘিয়া এলাকার ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম হেমায়েত বলেন, ভোটটা দলীয় প্রতীকে হওয়ায় স্থানীয় কোন ইস্যু আর কাজ করছে না। উন্নয়ন কিংবা ভালো প্রার্থীর মূল্যায়ন এখানে হবে না। সবাই দলীয় প্রতিক দেখেই ভোট দেবে।
Leave a Reply